অন্তর্নিহিত তাৎপর্য স্পষ্ট না হলেও ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ শব্দযুগল ব্যাপকভাবে পরিচিতি পেয়েছে। ইংরেজি ডিজিট শব্দের বিশেষণ হলো ডিজিটাল। ডিজিটের বাংলা অর্থ অঙ্ক; এখানে অঙ্ক অর্থ গণিত শাস্ত্র নয়। ব্যাপকভাবে ব্যবহার হওয়া দশমিক পদ্ধতির গণনার দশটি অঙ্ক : ০ হতে ৯; এই দশটি অঙ্কের ভিত্তিতে ডিজিটাল যন্ত্রপাতির বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব। বস্ত্তত কমপিউটার, ক্যালকুলেটর, মোবাইল ফোনসেটসহ সব ধরনের ডিজিটাল যন্ত্রপাতি ০ এবং ১ এই দুটি অঙ্কের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়। আধুনিক সভ্যতা ডিজিটাল যন্ত্রপাতির ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। ডিজিটাল যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়িয়ে দেশকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যাওয়াই ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য।
‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ একটি প্রত্যয়, একটি স্বপ্ন। বিরাট এক পরিবর্তন ও ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এখন এগিয়ে চলছে। একুশ শতকে বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে ৬ জানুয়ারি ২০০৯ শেখ হাসিনা বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দ্বিতীয়বারের মতো শপথ নেন। ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের বছরে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশ এবং তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বিনির্মাণই ছিল তাদের নির্বাচনী ইশতেহারের প্রধান বিষয়।
১২ ডিসেম্বর, ২০০৮ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা করে যে ‘২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশে’ পরিণত হবে।
একটি উন্নত দেশ, সমৃদ্ধ ডিজিটাল সমাজ, একটি ডিজিটাল যুগের জনগোষ্ঠী, রূপান্তরিত উৎপাদনব্যবস্থা, নতুন জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি—সব মিলিয়ে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের স্বপ্নই দেখিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ডিজিটাল বাংলাদেশ বস্তুত জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রথম সোপান। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য যে সমৃদ্ধি ও উন্নত জীবন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম, ডিজিটাল বাংলাদেশ আমাদের সেই স্বপ্ন পূরণ করবে।
বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপই হলো ডিজিটাল বাংলাদেশ। এর মাধ্যমে একটি উন্নত, বিজ্ঞানমনস্ক সমৃদ্ধি বাংলাদেশকে বোঝায়। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ হচ্ছে সেই সুখী, সমৃদ্ধ, শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর বৈষম্য, দুর্নীতি, দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ, যা প্রকৃতপক্ষেই সম্পূর্ণভাবে জনগণের রাষ্ট্র এবং যার মুখ্য চালিকাশক্তি হচ্ছে ডিজিটাল প্রযুক্তি।’
এটি বাংলাদেশের জনগণের উন্নত জীবনের প্রত্যাশা, স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা। এটি বাংলাদেশের সব মানুষের ন্যূনতম মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর প্রকৃষ্ট পন্থা। এটি বাংলাদেশের জন্য স্বল্পোন্নত বা দরিদ্র দেশ থেকে সমৃদ্ধ ও ধনী দেশে রূপান্তরের জন্য মাথাপিছু আয় বা জাতীয় আয় বাড়ানোর অধিকার। এটি হচ্ছে একুশ শতকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ডিজিটাল বাংলাদেশের পথিকৃৎ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কেননা, তিনি পথিকৃৎ হিসেবে লক্ষ অর্জনে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কাজ করে যাচ্ছেন।
ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রথম জাতীয় অঙ্গীকার হচ্ছে ডিজিটাল টুলস ব্যবহার করে দেশ থেকে দারিদ্র্য ও বৈষম্য দূর করা এবং জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা পূরণ করা।
এ জন্য জাতীয় পর্যায়ে অবকাঠামোগত উন্নয়নের অগ্রাধিকার থাকতে হবে। সারা দেশে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা। প্রতিটি ঘরকে তার বা বেতার-পদ্ধতিতে ডিজিটাল নেটওয়ার্ক-ব্যবস্থায় যুক্ত করতে হবে। দেশের সব অঞ্চলের জনগণকে ডিজিটাল যন্ত্রে সজ্জিত করাসহ ডিজিটাল ডিভাইস প্রণয়ন করা জাতীয় অগ্রাধিকার হিসেবে গণ্য হবে। এ ছাড়া আরও যেসব বিষয় অগ্রাধিকার হিসেবে গণ্য হবে তা হলো: জনগণের নিজস্ব সংযুক্তি, জনগণের সঙ্গে সরকারের সংযুক্তি, সরকারের ডিজিটাল রূপান্তর, শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তর, উপযুক্ত মানবসম্পদ তৈরি, কৃষি, শিল্প ও ব্যবসার রূপান্তর।
ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা: ১. প্রধান লক্ষ্য ২. রাজনৈতিক লক্ষ্য।
১. প্রধান লক্ষ্য: ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্তরে স্তরে এর অনুন্নত জীবনধারাকে বদলে বাংলাদেশের সমাজকে জ্ঞানভিত্তিক সমাজে রূপান্তর করা।
কার্যত এ দেশের মানুষের জীবনযাপন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবস্থাপনা, কর্মপদ্ধতি, শিল্প-বাণিজ্য ও উৎপাদন, অর্থনীতি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনধারা এবং জনগণের সরকারসহ সব স্তরের সব কাজকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে রূপান্তর করা।
২. রাজনৈতিক লক্ষ্য: ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কিছু রাজনৈতিক লক্ষ্য রয়েছে। নিচে তা সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো।
ক) জনগণের রাষ্ট্র: ‘ডিজিটাল টুলস ব্যবহার করে জনগণের উন্নত জীবন যাপনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন, মৌলিক মানবিক অধিকার সংরক্ষণ, সব সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার নিশ্চয়তা থাকবে। এই রাষ্ট্রের জনগণের কাছে এই প্রযুক্তি সহজলভ্য ও সুলভ করা হবে।
খ) মৌলিক চাহিদা রাষ্ট্রকেই পূরণ করতে হবে: রাষ্ট্রকে জনগণের ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে হবে। জনগণ যাতে করে জীবিকা নির্বাহ করতে সক্ষম হয়, তার জন্য তাকে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার শেখাতে হবে এবং সেই প্রযুক্তি তার কাছে রাষ্ট্রকেই সহজলভ্য করতে হবে। ‘দরিদ্র জনগণকে জ্ঞানকর্মী বা ডিজিটাল প্রযুক্তিকর্মী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে এবং গ্রামে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি, মেধা ও জ্ঞানভিত্তিক শিল্প-বাণিজ্যসহ কৃষি, শিক্ষা, টেলিযোগাযোগ ইত্যাদি খাতে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করতে হবে।’
গ) রাজনৈতিক ধারা: ডিজিটাল বাংলাদেশের লক্ষ্য হলো সরকার, জাতীয় সংসদসহ সব রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও ব্যবস্থা ডিজিটাল পদ্ধতিতে চালনা করা, যাতে জনগণ সব সময়ই সংসদ, সরকার ও রাজনীতিতে ইন্টার অ্যাকটিভ পদ্ধতিতে অংশ নিতে পারে।
ডিজিটাল বাংলাদেশের কর্মসূচি: ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে যেসব কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: সরকারের কাজ করার পদ্ধতি ডিজিটাল করা, জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছানো, ডিজিটাল ভূমিব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, ডিজিটাল স্বাস্থ্যব্যবস্থা, ডিজিটাল নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থাকে ডিজিটাল করা, কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যব্যবস্থার ডিজিটাল রূপান্তর, যোগাযোগব্যবস্থায় ডিজিটাল পদ্ধতির প্রচলন করা, তথ্যের অবাধ চলাচলের জন্য ডিজিটাল-ব্যবস্থা গ্রহণ।
অগ্রগতি: ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণার প্রথম বছরে দৃঢ়তার সঙ্গে গড়ে তোলা হয়েছে এর ভিত্তি বা প্রথম সোপান।
সরকার আইসিটি নীতিমালা অনুমোদন করেছে, সেটি বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ, ই-কমার্স চালু করা, নতুন নতুন প্রযুক্তির লাইসেন্স প্রদান করা, সরকারের কাজের পদ্ধতিতে পরিবর্তন করা।
কিছু প্রত্যাশা: তারহীন উচ্চগতির ইন্টারনেট ওয়াইম্যাক্স সহজলভ্য হোক এবং সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ুক—এই সবার প্রত্যাশা। ‘আশা করি, বাংলাদেশে দ্বিতীয় সাবমেরিন কেব্ল নেটওয়ার্কের কাজ সরকার তাড়াতাড়ি চালু করবে।’
‘বাংলাদেশের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে। আমরা যদি গ্রামের মানুষকে তথ্যপ্রযুক্তির প্রতি আগ্রহী করতে পারি, তাহলেই বাংলাদেশকে ডিজিটাল দেশ হিসেবে গড়ে তোলা যাবে।’
ডিজিটাল বাংলাদেশবিষয়ক সতর্কতা: বাংলাদেশে ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলে এর প্রভাব হিসেবে ডিজিটাল ডিভাইজ সম্প্রসারিত হতে পারে, যা ডিজিটাল বাংলাদেশের সুযোগ-সুবিধাভোগী শোষকগোষ্ঠী, ধনী বা বিশেষ সম্প্রদায়, শ্রেণী-গোষ্ঠীর জন্য আরও সহায়ক হতে পারে। কিন্তু জ্ঞানভিত্তিক সমাজে জ্ঞানহীন হওয়ায় সুযোগহীন মানুষের জীবনযাপন আরও কষ্টকর হতে পারে।
২০২১ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানে অর্থ ও শারীরিক শক্তির বদলে মেধা ও জ্ঞানের শক্তির প্রাধান্য থাকবে। কৃষিভিত্তিক একটি সমাজ থেকে বাংলাদেশ একটি সৃজনশীল ও মেধাভিত্তিক শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হয়ে মানবসভ্যতার ডিজিটাল যুগে নেতৃত্ব দেবে। আর এই স্বপ্ন পূরণের জন্য সরকার ও জনগণকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস